কোনো ঋণখেলাপি বিদেশের মাটিতে দেশের টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন না। বিনিয়োগ করতে হলে খেলাপি ঋণ বা অসমন্বিত পুনর্গঠিত বড় ঋণ নেই- এ মর্মে সনদ দাখিল করতে হবে। কোনো কারণে বিদেশে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে বিলম্ব ছাড়াই দ্রুত ওই টাকা দেশে ফেরত আনতে হবে। পাশাপাশি টাকা ফেরত আনার অগ্রগতির বিষয়ে নিয়মিতভাবে অবহিত করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এক্ষেত্রে টাকা ফেরত আনতে ব্যর্থ হলে তা অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসাবে তা বিবেচিত হবে। উল্লিখিত শর্ত রেখে ‘সরকারি মূলধনী হিসাব লেনদেন (বিদেশে ইকুইটি বিনিয়োগ)’ সংক্রান্ত বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্টদের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর খুব শিগগিরই বিধিমালা আকারে তা জারি করা হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য। খসড়া বিধিমালায় বলা হয়, বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হলে এবং তা ফেরত আনতে না পারলে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী, পরিচালক, প্রধান নির্বাহী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর জন্য দায়ী হবেন। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইন এবং দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট-১৯৭৪-এর বিধান মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ওই অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে টাকা আদায় করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাবেক নির্বাহী সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) নাভাস চন্দ্র মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, একজন ঋণখেলাপিকে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য কীভাবে উৎসাহিত করা যায়। আমার দৃষ্টিতে করা যায় না। এছাড়া বিনিয়োগের জন্য টাকা নেওয়া হলো এরপর তা বিনিয়োগ করল না এবং ঠিকমতো ফেরত আনছে না। প্রকারান্তরে এটি অর্থ পাচার হবে। এ বিধিমালায় এটি সঠিক বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। নীতিমালাটি এখন প্রণয়ন শেষ হয়নি। সেখানেও একই বিধান রাখা হয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে বিদেশে দেশি কোনো কোম্পানি বিনিয়োগের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। পরে সেটি আর অগ্রসর হয়নি। তবে বিদেশে বিনিয়োগ থেমে নেই। বিদেশের মাটিতে দেশি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ কেস টু কেস ভিত্তিতে অনুমোদন দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত বছর একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয় বিদেশে বাংলাদেশি কোম্পানির নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। সেটির কাজও চলছে। সূত্র আরও জানায়, বিদেশে বিনিয়োগের আবেদনকারী একজন রপ্তানিকারক হতে হবে। তার রপ্তানি আয় সংরক্ষিত কোটা হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি আছে-এমন প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের লক্ষ্যে টাকা পাঠানোর জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে বিনিয়োগের পরিমাণ হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের বার্ষিক গড় রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ। এর বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না। অথবা ওই প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদনের প্রদর্শিত নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ। অথবা এই দুইয়ের মধ্যে যেটি কম তার চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা যাবে না। বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়, বিনিয়োগ করতে হলে ওই কোম্পানির কোনো শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর বকেয়া থাকা যাবে না। সব প্রকার আমদানি দায়, ব্যাংক টু ব্যাংক ঋণপত্রসহ যে কোনো আমদানির বিপরীতে অসমন্বিত বিল অব এন্ট্রি থাকলে বিনিয়োগের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এছাড়া গত ৫ বছরের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী আবেদনকারী কোম্পানিকে আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকতে হবে। সেখানে আরও বলা হয়, বিদেশে বিনিয়োগকৃত খাতটি হতে হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। এছাড়া দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি, বিদেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অন্যান্য সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতে হবে। আর ওই কোম্পানির আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনা, অর্থায়ন ও বিনিয়োগের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ জনবল বা মানবসম্পদ থাকতে হবে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের। শর্তে আরও বলা হয়, বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফা লভাংশ ত্রিশ দিনের মধ্যে দেশে আনতে হবে। খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই সেখানে বিনিয়োগ করা যাবে না। পাশাপাশি জাতিসংঘ (ইউএন), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রকের দর কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এমন দেশে বিনিয়োগ করা যাবে না। এছাড়া ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএ) গণবিজ্ঞপ্তিতে অবৈধ লেনদেনের জন্য চিহ্নিত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে, সেখানে দেশের অর্থে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়, যেসব দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের কাজ করা ও তাদের অর্জিত অর্থ দেশে পাঠানোর বাধা নেই, সেসব দেশে বিনিয়োগ করা যাবে। এছাড়া যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বৈত কর পরিহার, সরকারের দ্বিপাক্ষিক পুঁজি বিনিয়োগ, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ চুক্তি আছে, সেখানেও বিনিয়োগ করা যাবে। সর্বশেষ বলা হয়, দেশের অর্থে বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগ থেকে মূলধনী লাভসহ মূলধন, মুনাফা, লভ্যাংশ, সুদ, শেয়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থ, বিনিয়োগ বিলুপ্তির ফলে অবশিষ্ট অর্থ দেশে আনার অনুমোদন আছে, সেখানে বিনিয়োগে বাধানিষেধ নেই। বিশেষ করে অন্য আয় হিসাবে স্বীকৃত কারিগরি প্রজ্ঞাপন ফি, রয়্যালটি, পরামর্শক ফি, কমিশন ও অন্যান্য প্রাপ্য ফেরত আনার অনুমোদন আছে। বিধিমালার খসড়া মোতাবেক দেশের ভাবমূর্তি বিনিষ্টকারী কোনো প্রকার কার্যক্রম গ্রহণ ও সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবে না বিনিয়োগকারী কোম্পানি। আর বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য আয় পুনরায় বিনিয়োগ করা যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া। এছাড়া অর্থ পাচার, সন্ত্রাস অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্তৃক স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি অবমাননাকর আচরণ, মন্তব্য, বর্ণবাদী আচরণ ও কার্যকলাপের বিষয়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে শূন্য সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করতে হবে।